সৈকত দত্ত, শরীয়তপুর থেকেঃ পদ্মা নদীর ভাঙ্গন, ঢেঁউ ও বন্যার পানি দেখে আর ভয় পাই না। এমন কথাই শুনতে হলো চর নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেনীর শিক্ষার্থী হোসেন ও নুরউদ্দিনের মুখ থেকে। প্রতিদিনই পদ্মা নদীর কড়াল স্্েরাতের গর্জণ শুনে মনের নরম কোণে কঠিন কিছু জমাট বাঁধতে শুরু করেছে তাদের।
প্রতি বছরই পদ্মার ভাঙ্গনের বকল থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে হয় অনেকের বসত বাড়ি। এ সবই চলতে থাকে ৮ বছর বয়সী শিশু হোসেন ও নুরউদ্দিনের চোখের সামনে। কিছুদিন হয়ে গেল শ্রেনী কক্ষে হাটু পরিমান পানিতে দাড়িয়ে পাঠ গ্রহন করেছে তারা। শ্রেনী কক্ষ ও বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে পানি নেমেছে। তবুও পদ্মার পানি নদীর পাড় ছুঁইছুঁই। ভাটার সময় পদ্মার পানি একটু কমলেই পদ্মার ঢেঁউ আঘাত হানে পাড়ে। আবার ভাঙ্গতে শুরু করেছে পদ্মার পাড়। কয়েক দিনে পদ্মার পাড় ভেঙ্গে বিদ্যালয়ের মাঠ নদী হয়েছে। তাই পদ্মার ঢেঁউ, ভাঙ্গন ও বানের পানি দেখে পদ্মা পাড়ের মানুষ আর ভয় পায় না।
জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, জাজিরার কুন্ডেরচর সরকারি প্রাথমি বিদ্যালয়, কলমিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নড়িয়া উপজেলার চর নড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর জুজিরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরভাগা হাওলাদারবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বিদ্যালয়ে পাঠদান চলছে তবে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কিছুটা কম। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি প্রস্তুত রয়েছে সমস্যা হলে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নিরাপদে সরিয়ে নিতে।
নদী ভাঙ্গন এলাকার নির্বাহী কর্মকর্তাগণের কার্যালয় সূত্র জানা যায়, বন্যার পানি দ্রুত নেমে গেছে। তবে পদ্মার তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও সরকারি স্থাপনা নদীগর্ভে বিলিন হয়েগেছে আবার কোথাও ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এরমধ্যে জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা, বড়কান্দি, পালেরচর, বিলাশপুর, কুন্ডেরচর নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর, ঘড়িষার, চরআত্রা, নওপাড়া, ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরভাগা, কাচিকাটা ও উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নে ভাঙ্গন অব্যাহত হয়েছে।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা নদীতে পানি বাড়ায় জুলাইর মাঝামাঝি থেকে জেলার জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার কিছু নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়। নদীর তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। পন্যার পানি নেমে গেলেও নদী ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। এতে ৩টি বাজার ও প্রায় ১ হাজার পরিবার সহ বিপুল পরিমান ফসলী জমি ভাঙ্গনে কবলিত হয়েছে।
শনিবার সকাল থেকে পুনরায় দক্ষিন পূর্ব কোণ থেকে বাতাস বইতে শুরু করেছে। সেই সাথে ভাঙ্গতে শুরু করেছে পদ্মার পাড়। পদ্মার তীরবর্তী পূর্ব নড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। নদীর পাড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দাড়িয়ে থেকে নদীর ঢেঁউ দেখে আর বলে এই মাঠে আমরা দাড়িয়া বাঁধা খেলতাম আজ বিদ্যালয়ের অংশসহ মাঠ নদীগর্ভে।
চর নড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা আক্তার নাসরিন বলেন, আমি খুব ভীতু ছিলাম। এখন প্রতিদিন দায়িত্ব নিয়ে নড়িয়া থেকে ট্রলার যোগে বিদ্যালয়ে আসি। আমার সহকারী শিক্ষকগণ বলে পদ্মার তীরের বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আমিও নদী ভাঙ্গন কবলিত লোকের মতো সাহসী হয়েছি। তবে সাহসিকতার সাথে এখনও বিদ্যালয় ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। সকল বিষয় আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবগত করছি। তবে বিদ্যালয়ের ক্যাচম্যান্ট এরিয়া নদীতে বিলিন হওয়ায় শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন দিন কমছে।
পাশবর্তী চর জুজিরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ সোলায়মান বলেন, আমি ২০১৩ সাল থেকে এ বিদ্যালয়ে কর্মরত আছি। এর মধ্যে ৪বার স্তান পরিবর্তন করে এখন স্বল্প পরিসরে ভাড়া জমিতে পাঠদান দিচ্ছি। এ বছর পদ্মা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বিদ্যালয়ের নিকটে এসেগেছে। যে কোন সময় আবার স্থান পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। নদী ভাঙ্গনে আমাদের বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এরিয়া আর নাই। উত্তর কেদারপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিছু ক্যাচমেন্ট এরিয়া নিয়ে কাজ করছি।
জাজিরা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নেই ধারাবাহিক ভাবে নদী ভাঙ্গনে বিলিন হচ্ছে বসত বাড়ি, ফসলী জমি ও সরকারী স্থাপনা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভাঙ্গন কবলিত এলাকার পরিবারগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ সব এলাকার লোকজন দিন রাত করে তাদের বসত ঘর, আসবাপত্র, গবাদী পশু ও গাছ পালা কেটে সরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বড়কান্দি ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম জানায়, বড়কান্দি ইউনিয়নের নারিকেল বাড়িয়া ও কুড়িটাকার চর এই ২টি মৌজা সম্পূর্ণ নদী গর্ভে। এক বিন্দু জমিও অবশিষ্ট নাই। ভাঙ্গন এলাকায় বিকে মডেল হাই স্কুল ও বড়কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল তা এখন স্থানান্তরিত করে আব্দুল বেপারীর কান্দি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে।
জাজিরা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, এখন কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি নাই। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। তবে কুন্ডেরচর সুরত খা কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলমির চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে উভয় বিদ্যালয়ের এসএমসি সভাপতি তৎপর রয়েছে সমস্যা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবে।
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল কাদের বলেন, উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়। বন্যার পানি নেমে গেলেও নদী ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে প্রতিটি ইউনিয়ন। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়ে পাঠদান চলছে। তবে প্রস্তুতি রয়েছে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হলে তাৎক্ষনিক সরিয়ে নেয়া হবে।