সুমন দত্ত
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন বড় খবর ইরান ইজরাইল যুদ্ধ। গত কয়েকদিন দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিষ্কার হবে এই যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নিবে। এই মুহূর্তে ইরানের আকাশসীমা দখল করে রেখেছে ইজরাইল। সঙ্গে আছে আমেরিকা। ইজরাইলের আক্রমণে ইরানের শীর্ষ কমান্ডারদের বেশিরভাগ পরপারে। এই মুহূর্তে ইরানের সামরিক বাহিনী প্রধান কে? কেউ বলতে পারে না।
যিনি সেনা প্রধান ছিলেন তিনি ইজরাইলের হামলায় শেষ হয়েছেন। এরপর খামেনি যাকে দায়িত্ব দিল তিনিও কয়েকদিনের ব্যবধানে শেষ। এখন কৌশলগত কারণে সেনা প্রধান নির্বাচিত করতে পারছেন না খামেনি। সম্প্রতি নতুন গোয়েন্দা প্রধান নিয়োগ দিয়েছে ইরান। দেখা যাক কতদিন বাঁচে।
ইজরাইলের এমন চুলচেরা আক্রমণ থেকে বোঝা যায় যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই এই যুদ্ধে নেমেছে দেশটি। তা না হলে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইরানের এতগুলো শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা মারা গেল কীভাবে? শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীরাই কীভাবে মারা গেল? ইজরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এত তথ্য পেল কীভাবে? বিপরীতে ইরানের আক্রমণে এখন পর্যন্ত ইজরাইলের শীর্ষ কাউকে মরতে দেখা গেল না। যারা মারা গেছে তারা বেসামরিক লোকজন।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন ইজরায়েল এই সময়ে কেন ইরান আক্রমণ করল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। যেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা অজুহাত হিসেবে দাড় করাচ্ছে। এদিকে আমেরিকার জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গাবার্ড বলেছেন ইরান পরমাণু বোমা বানাচ্ছে না। তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে ইজরাইল এই হামলার পেছনে একাধিক কারণ দেখাচ্ছে। যেটা সত্য এবং বাস্তব।
ইজরাইল ফিলিস্তিন থেকে হামাসের, লেবানন ও সিরিয়া থেকে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেন থেকে হুতি। এই তিনটি মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে বছর জুড়ে যুদ্ধ করছে ইজরাইল। এদের জন্য ব্যয় করছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এর কোনো সমাধান দিতে পারেনি জাতিসংঘ কিংবা আমেরিকা। আর এই তিন গ্রুপ প্রকাশ্যে সমর্থন পাচ্ছে ইরানের কাছ থেকে। আর ইরানের নেতৃত্ব রাতদিন ইজরাইলের ধ্বংস চেয়ে মাইকিং করে। তাদের রাজনীতির বড় একটা অংশ ইজরাইল বিরোধিতা ও তাদের ধ্বংস। যেটা মধ্যপ্রাচ্যের আরো কোনো দেশ করে না। খোদ ফিলিস্তিনিরাও করে না। বহু ফিলিস্তিনি ইজরাইল ভূখণ্ডে বাস করেও ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেখতে চায় কিন্তু তারা ইজরাইলের ধ্বংস চায় না।
ইয়াসির আরাফাত থাকতে ফিলিস্তিন ইজরাইল সংকট অনেকটা কমে এসেছিল। বেশ কয়েকটি শান্তি চুক্তি ইজরাইল ও ফিলিস্তিনের সঙ্গে হয়েছিল। যেটার বিরোধিতা করেছিল তৎকালীন প্যালেস্টাইনের হামাস ও ইসরাইলের লিকুদ পার্টি বর্তমানে নেতানিয়াহু যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর এই হামাসের কারণে ইজরাইলের এই গাজা আক্রমণ। হামাস সেদিন ইজরাইলে আক্রমণ না করলে গাজার এই দশা হতো কিনা সন্দেহ। সেদিনও বিশ্ববাসী জেনে গিয়েছিল গাজা আর থাকছে না। বর্তমানে আজ সেটাই হলো।
হামাসের অনুসন্ধানে হাজার হাজার গাজাবাসীর উপর ইজরাইল বর্বরতা চলমান। যেটার বিপক্ষে সমগ্র বিশ্ব সরব হলেও কেউ ইজরাইলকে থামাতে পারছে না। এখন ইজরাইল নাটের গুরু ইরানকে ধরেছে।
ইরানের কাঠমোল্লারা তাদের দেশে জোর করে বসে আছে। ইরানের খামেনি নারীদের কঠোর শরিয়া শাসনে রাখার পক্ষপাতী। চুন থেকে পান খসলে তাদের জেলে পুড়ে নির্যাতন করা হতো। খামেনির বিরোধিতা করলেই ইজরাইলের এজেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হতো। এভাবে খামেনি কত হাজার ইরানিকে বিনা বিচারে মেরেছে তার হিসাব হয়ত এই খামেনি পতনের পর জানা যাবে।
ইজরাইল সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ইরানকে নিয়ে ইসরাইলের এজেন্ডা পরিষ্কার তারা ইরানের এই কট্টর পন্থার পরিবর্তন চায়। তারা ইরানকে একটি উদারবাদী দেশ হিসেবে দেখতে চায়। হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ এসব সন্ত্রাসীকে মদদ দেওয়া হবে না এমন শক্তিকে সেখানে বসাতে চায়। যেটা সাদ্দাম পতনের পর ইরাকে হয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি এই মুহূর্তে তলানিতে। ইরান সব দেশের সঙ্গে স্বাধীনমত বাণিজ্য করতে পারে না। ক্ষমতার পালা বদল হলে এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যেতে পারে। তখন হয়ত নতুন এক ইরানের অভ্যুদয় হবে। এরকম একটা ভিশন হয়ত রাশিয়া চীনের কাছে তুলে ধরেছে ইজরাইল। যে কারণে ইরানের পক্ষে চীন ও রাশিয়া যেভাবে এগিয়ে আসার কথা সেভাবে এই দেশ দুটিকে পাচ্ছে না ইরান।
বলা হচ্ছে চীন থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পাচ্ছে ইরান। অস্ত্র বোঝাই কার্গো ইরানে আসছে। ইরান লম্বা একটা যুদ্ধ করবে। বুঝলাম ইরান সবকিছু পেল। কিন্তু মাথা বিহীন শরীরের কোনো মূল্য আছে কি? ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই নিহত। এই অবস্থায় ইরান কোথা থেকে রাতারাতি শীর্ষ কর্মকর্তা তৈরি করবে। সামরিক বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড বলে একটা কথা আছে। খামেনির আস্থা-ভাজন অনুসারীরাই ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পদগুলোতে বসেন। এখন সেখানে যদি এই অবস্থায় ভুল করে খামেনি বিরোধী কেউ বসে যায় তখন হিতে বিপরীত হতে পারে।
প্রাণ বাঁচাতে খামেনি নিজেই পরিবার সমেত আত্মগোপনে চলে গেছেন। এই অবস্থায় ইরানের সামরিক কর্তৃত্ব ধরে রাখা খুব কঠিন।
তার চেয়ে বরং আত্মসমর্পণ করলেও সব কুল রক্ষা হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প খামেনিকে আত্মসমর্পণের একটা সুযোগ দিয়ে রেখেছে। সেই মত যদি খামেনি আত্মসমর্পণ করে তবে যুদ্ধের এই ঘনঘটা মধ্য প্রাচ্য থেকে চলে যাবে। এমনকি ইরানের জনগণের জন্য ভালো হবে। ইরান তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে যা আজ থেকে ৫০ বছর আগে ইরানে ছিল। তখন ইসরাইল ইরান আমেরিকা বন্ধু হিসেবে একসঙ্গে চলত ফিরত। খুমিনির ইসলামিক বিপ্লব ইরানকে আমেরিকা ইসরাইলের শত্রুতে পরিণত করে। যা আজকের দিনে একটি বিষফোড়া।
ইরানের এই অবস্থা নিয়ে ভারত পাকিস্তানে যা হচ্ছে। পাকিস্তানের জনগণ ইরানের পক্ষে। সে কথা দেশটির পার্লামেন্টে তাদের এমপিরা জানালেও তাদের সেনা নেতৃত্ব সেটা মানতে পারছে না। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ ইজরাইল বিরোধিতা করতে যেয়ে পরে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। এমনকি ইরান পাকিস্তান সীমান্ত বন্ধ করে নিজেদের অবস্থান জানান। এদিকে ট্রাম্প পাক সেনা প্রধান আসিম মুনিরকে তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা বলেন। ইরান আক্রমণে পাকিস্তানের সেনাঘাটিগুলোকে চেয়েছেন। এমন খবর সিএনএন নিউজ১৮ থেকে বলা হচ্ছে। পাকিস্তান মার্কিন দাবি পূরণ করলে তাকে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দেওয়া হবে এমন টোপ দেন ট্রাম্প।
ভারত এই যুদ্ধে শান্তি চায়। কারণ ভারতের বিনিয়োগ ইরানেও আছে। আবার ইজরাইলেও আছে। যুদ্ধ হলে ভারতেরই ক্ষতি বেশি। ইরানের চাবাহার বন্দরে ভারত হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। আবার ইজরাইলে হাইফা বন্দরও ভারতের বেসরকারি কোম্পানি আদানি কিনে রেখেছে। এই অবস্থায় ভারত দুই দেশের স্বার্থ দেখেই মন্তব্য করে যাচ্ছে। তবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী জনগণ ইজরায়েলের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে কংগ্রেসের মতো মুসলিম লাভার দলগুলো ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইজরায়েল মোদির সমালোচনা করছে।
লেখক: সাংবাদিক