ভারতের জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের এক জ্বলন্ত শিখা, ভারত কেশরী, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন আজ। বাংলার এই মহান ভূমিপুত্র ১৯০১ সালের আজকের দিনে অর্থাৎ ৬ই জুলাই কলকাতার এক উচ্চ সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
স্যার আশুতোষ মুখার্জী ও মাতা শ্রীমতী যোগমায়া দেবীর সুযোগ্য সন্তান ছিলেন তিনি। সুতরাং ঐকান্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন তিনি। অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন এই স্নাতক ছাত্র ১৯২১ সালে ইংরেজি সাহিত্যে কলেজে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপরে তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৪ সালে তিনি বি.এল পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন। ভারত কেশরী
তিনি কর্মজীবনে প্রথমে কলকাতা হাই কোর্টে একজন আইনজীবী হিসাবে যোগদান করলেও ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম উপাচার্য হিসাবে দায়ীত্বভার গ্রহন করেন। ডাঃ মুখার্জীর রক্তে ছিল উচ্চ আদর্শবাদ এবং কঠিন দৃঢ়সঙ্কল্প ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবন। ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী এলাকা থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন। সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করলেও কংগ্রেস পরিষদ বর্জনের ডাক দিলে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি ১৯৩৭ সালে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে পরিষদে পুনরায় যোগ দিয়ে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রের হিতার্থে কাজ করেন। কংগ্রেসের সঙ্গে মতবিরোধে তিনি অ-কংগ্রেসীয় ও অ-মুসলিম লীগ দলীয় জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহের সমর্থন লাভ করেন। ফলে তিনি এ.কে.ফজলুল হক এর সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেন যেখানে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। ওই সময় বীর সাভারকারের থেকে অনুপ্রাণিত হয় এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেন পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চলাকালে তাঁর মানব সেবায় আত্মনিবেদন অনেক মূল্যবান জীবন বাঁচিয়েছিল। এর কিছুকাল পরেই ভারত বিভক্তির অশুভ ছায়া জন-মানসে স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন ভারত বিভক্তির কঠোর বিরোধী। সর্বদা তিনি অখণ্ড ভারতের দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। তৎকালীন ইংরেজ সরকার অনুভব করেছিল যে ভারত বিভক্ত না করলে এই ভারতবর্ষ একসময় পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিশ্বে রাজত্ব করবে। তাই শেষ পেরেকটি তারাই পুতে দিয়ে গেল স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের সহায়তায় । আজ একই মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও দুই বাংলার মানুষ দুটি আলাদা রাষ্ট্রের নাগরিক আর এই দেশ ভাগের যন্ত্রনা যুগযুগ ধরে চলবে।
এরপর ভারত তাঁর স্বাধীনতা অর্জন করল। স্বাধীন ভারতে নেহেরুর প্রথম মন্ত্রী সভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কিছুকাল শিল্প ও সরবরাহ দফতরের মন্ত্রীত্ব সামলেছেন। কিন্তু নেহেরুর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি ইস্তাফা দিয়ে বেরিয়ে এসে যথার্থ গণতান্ত্রিক বিরোধী দল সৃষ্টিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। “ভারতীয় জনসংঘ দল” তার নিজেরই সৃষ্টি। লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা হিসাবে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি “পার্লামেন্ট এর সিংহ” উপাধি পান। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদী অখণ্ডতার প্রতীক, তিনি কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তাঁর অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল “এক দেশে দুই বিধান, দুই প্রধান, দুই নিশান চলবে না”।
তিনি ১৯৫৩ সালে কাশ্মীরের উদ্দেশে রওনা দেন, কিন্তু ভারত থেকে কাশ্মীরে প্রবেশ করার আদেশ না থাকার অপরাধের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আব্দুলার নির্দেশে ডঃ মুখার্জীকে ১১ মে ১৯৫৩ সালে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শোনা যায়, সেখানে তাঁর বারন করা সত্বেও তাঁর উপর ভুল ইঞ্জেক্সন দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে ভুল চিকিৎসা বা বিনা চিকিৎসার কারনে ও অন্য কিছু অজানা কারনে রহস্যময় পরিস্থিতিতে ডঃ মুখার্জীর মৃত্যু ঘটে। ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে কাশ্মীরে পয়জন ইঞ্জেক্ট করে খুন করা হয়েছিল – জহরলাল নেহেরু ও শেখ আবদুল্লাহ-র মিলিত ষড়যন্ত্রে। শ্যামাপ্রসাদের আত্মবলিদানের জন্যই আজ জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অঙ্গরাজ্য।
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী এবং ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদের মাতা যোগমায়া দেবী – নেহেরুর কাছে বার বার অনুরোধ করেছিলেন, তদন্ত কমিশন গঠন করে তাঁর ছেলের মৃত্যুরহস্যের সুরাহা করার জন্য। নেহেরু কর্ণপাত করেন নি,পাছে নিজের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যায়।