ব্রিটিশ সরকার পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে। তাতে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও এলিট হিন্দুরা মনে করেছিল ― বাংলা ভাগ হলে তাদের পূর্ব-বঙ্গস্থ জমিদারি চলে যাবে। আসলে তাদের জমিদারি চলে যেত না; তাদের কোন ক্ষতিই হতো না। কারণ এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে গিয়ে জমিদারি করতে পারত, সম্পত্তি কিনতে পারত, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, চাষবাস সবাই করতে পারত; এখনো পারে।
কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও এলিট হিন্দুরা, বঙ্গভঙ্গ ঠেকানোর জন্য দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলল। রাজ্য ভাগ হওয়া – তাদের কাছে ছিল দেশপ্রেম হত্যার শামিল! বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গান বাজনা নাটক বহু কিছু রচনা হলো। তাতেও যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন বাচ্চা ছেলেদের ব্রেইন ওয়াশ করে – তাদের দিয়ে ব্রিটিশের উপর বোমা হামলা শুরু হলো। লক্ষ্য করুন, বাংলা ভাগ ঠেকানোর উদ্দেশ্যে – ব্রিটিশ নারী ও শিশুদের উপর বোমা হামলা চালাতে গিয়ে, সর্বপ্রথম জীবন দিয়েছিলেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু। এই দু’জনই ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালক। বঙ্গভঙ্গ ঠেকানেওয়ালা প্রাপ্তবয়স্ক অগ্নিপুরুষ কিংবা বিপ্লবী মধ্যবয়স্ক মহানায়করা- কেউ কিন্তু বোমা মারতে যায়নি। তারা গরম গরম বক্তৃতা দিয়েছে, গান বাজনা করেছে, আর অল্পবয়সী ছেলেদের মাথা নষ্ট করেছে। অপরিণত বয়স্ক প্রতিভাবান ছেলেদের ভুলভাল বুঝিয়ে, তাদের অকালে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে – এই সমস্ত অদূরদর্শী জ্ঞানপাপীরা।
বোমাবাজিতে অতিষ্ট হয়ে- ১৯১১ সালে ব্রিটিশরা কলকাতা থেকে তাদের রাজধানী গুটিয়ে নিয়ে গেল দিল্লিতে। আর বলে গেলো, “তোদের বাংলা আমরা ভাগ করব না।” রাজধানী সরিয়ে নেওয়ায় – তৎকালীন এশিয়ার সর্ববৃহৎ মহানগরী কলকাতার গুরুত্ব যথেষ্ট কমে গেল। বিহার(ঝাড়খণ্ড), উড়িষ্যা ও আসাম বলল, “আমরা বোমাবাজ বাঙালিদের সঙ্গে থাকবো না।” ১৯১২ সালে এই রাজ্য তিনটি বাংলা থেকে আলাদা হয়ে গেল। পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে পৃথক প্রদেশ গঠিত না হওয়ায়, ফিউডাল ও পেশাজীবী মুসলমানরা ক্ষেপে গেল। তারা মুসলিম লীগ গঠন করল এবং বিপুল ভোটে অবিভক্ত বাংলার শাসনভার লাভ করল। এর পরের ইতিহাস সবার জানা ― পাকিস্তান আন্দোলন, ক্যালকাটা কিলিং, নোয়াখালী রায়ট ইত্যাদি।
যে সমস্ত বাঙালি এলিট হিন্দু, জান-প্রাণ দিয়ে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে ― সেই এলিট হিন্দুরাই ১৯৪৭ সালে এসে ১৮০° ঘুরে গিয়ে বলল, “ভারত যদি ভাগ না-ও হয়, তবুও বাংলা ভাগ করতে হবে!” আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বাঙালি এলিট হিন্দুরা – অতীতের হঠকারী কর্মকাণ্ডের জন্য সামান্যতম ভুল স্বীকার করলো না। ১৯০৫ সালে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও এলিট হিন্দুরা যদি বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা না করতো, তাহলে মুসলিম লীগ সৃষ্টি হতো না, পাকিস্তানের দাবি উঠত না, দেশভাগ হতো না, এত রক্তপাত হতো না। আজও কলকাতা থাকতো অবিভক্ত ভারতের রাজধানী। অবিভক্ত ভারতের রাষ্ট্রভাষা হতো বাংলা। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে – কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বাঙালি এলিট হিন্দুরা বিরাট ভুল করেছিল। সেই ঐতিহাসিক ভুলের কত যে মাশুল দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে এবং এর শেষ কোথায় – সেটা কেউ জানে না! একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশভাগের সবচেয়ে বড় ভিকটিম পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা।