যাচাই-বাছাইয়ে গণহারে বিএনপির প্রার্থী বাদ পড়লেও ব্যতিক্রম আওয়ামী লীগের। সরকারি দলের প্রার্থী হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়ন জমা দেওয়া কোনো প্রার্থীর বাদ পড়ার খবর পাওয়া যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁরা গণহারে বাদ পড়েছেন।
বাদ পড়ার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের বেশির ভাগই বাদ পড়েছেন ভোটারের স্বাক্ষরসংবলিত তালিকায় গড়বড়ের অভিযোগে। কেউ কেউ বাদ পড়েছেন দলীয় মনোনয়নপত্র জমা না দিয়েও নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার কারণে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করতে হলে তাঁর প্রার্থিতা পক্ষে সমর্থন যাচাইয়ের জন্য ওই আসনের মোট ভোটারের ১ শতাংশ ভোটারের সইসহ তালিকা জমা দিতে হবে। অবশ্য সাবেক সাংসদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সারা দেশের ৪০ টির বেশি আসনে ৭৩ জনের মতো দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, দলের নেতারা যাঁদের বলছিলেন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। যাচাই-বাছাইয়ের সময় তাঁদের বেশির ভাগেরই মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে। নিজেদের দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, এমন আসন ছাড়াও জোটের শরিক বা মিত্রদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনেও বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। জোট শরিক বা মিত্রদের যেসব আসনে একাধিক বিদ্রোহী ছিলেন, এর মধ্যে কোথাও একজন, আবার কোথাও দুজন টিকে গেছেন।
তবে গতকাল রোববার সারা দেশে প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়া প্রার্থীদের বিষয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা যেসব তথ্য পাঠিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া অন্তত ৩৫ জন বাদ পড়েছেন। বাদ পড়া প্রার্থীদের মধ্যে সাবেক সাংসদও আছেন। এই হিসাবের বাইরেও বাদ পড়া প্রার্থী আরও থাকতে পারেন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্রোহীদের ব্যাপারে এবার আওয়ামী লীগ খুবই কঠোর। আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, কেউ বিদ্রোহী হলে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। যাচাই-বাছাইয়ে বেশির ভাগ বাদ পড়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা খুশি। এ ছাড়া দলীয় ও প্রশাসনিকভাবে চাপ দিয়ে অনেককে শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করারও পরিকল্পনা আছে। বিদ্রোহীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দলের একটি কমিটি কাজ শুরু করেছে।
কুষ্টিয়া-১ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ রেজাউল হক চৌধুরীকে বাদ দিয়ে আ ক ম সরোয়ার জাহানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ রেজাউল হক ও এই আসনের আরেক সাবেক সাংসদ আফাজ উদ্দিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। গতকাল বাছাইয়ে দলীয় প্রার্থী সরোয়ারের পাশাপাশি বিদ্রোহী রেজাউল হক টিকে যান। তবে আফাজ উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। কারণ, তিনি মনোনয়নপত্রে নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু দলীয় মনোনয়নের চিঠি জমা দিতে পারেননি।
হবিগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি হলফনামার একটা অংশ পূরণ করেননি। তাঁর সই নিয়েও সমস্যা আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আপিল করবেন। এই আসনের বর্তমান সাংসদ জাতীয় পার্টির আবদুল মুনিম চৌধুরী। তিনি এবার দলের মনোনয়ন পাননি, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগ শাহনেওয়াজ মিলাদ গাজীকে মনোনয়ন দিয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় দণ্ড থাকার অভিযোগে ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সাংসদ আবদুল ওহাবের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এই আসনে বর্তমান সাংসদ আবদুল হাই এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
ঝিনাইদহ-৪ আসনে বর্তমান সাংসদ আনোয়ারুল আজীম আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সাবেক সাংসদ আবদুল মান্নানও আওয়ামী লীগের প্রার্থী উল্লেখ করে মনোনয়নপত্র জমা দেন, কিন্তু দলীয় মনোনয়নের চিঠি জমা দিতে পারেননি। এ কারণে বাছাইয়ে তিনি বাদ পড়েছেন।
রাজশাহী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ মেরাজ উদ্দিন মোল্লার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এই আসনে বর্তমান সাংসদ আয়েন উদ্দিন দলের প্রার্থী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগ কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। এই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ার আলোচনা আছে। তবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদধারী অন্তত ছয়জন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে চারজনই গতকাল বাছাইয়ে বাদ পড়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মঈন উদ্দিন ও আশরাফ উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম-৪ আসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল বাঁকের ভূঁইয়া বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে সইয়ে গোলমাল থাকার কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এই আসনে বর্তমান সাংসদ দিদারুল আলম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।
ঝালকাঠি-২ আসনে শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মনিরুজ্জামান। বড় ধরনের জমায়েত নিয়ে ঢাকায় দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাননি। এরপর তিনি দলীয় বর্তমান সাংসদ বি এইচ হারুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হন মনিরুজ্জামান। কিন্তু ১ শতাংশ ভোটারের তালিকায় সই গরমিলের অভিযোগের তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।
গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে উপনির্বাচন করেছিলেন তাঁর বোন আফরুজা বারী। কিন্তু তিনি জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারীর কাছে হেরে যান।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আফরুজা এবার দলের মনোনয়ন পাননি। এ আসনে আওয়ামী লীগ কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। জাতীয় পার্টিকে এটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আছে। এ অবস্থায় আফরুজা বারী বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয় ভোটারের সই গরমিলের অভিযোগে।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে হলফনামায় মামলার তথ্য গোপন করার অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী কাউসার আহমেদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রমিক উন্নয়ন ও কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন এ কে এম শামীম ওসমান।
নোয়াখালী-২ আসনে ভোটারের সইয়ে গরমিল থাকার অভিযোগে বাতিল হয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মো. আতাউর রহমান ভূঁইয়ার মনোনয়নপত্র। তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক। বর্তমান সরকারের আমলে রেল ও সড়ক খাতে প্রচুর ঠিকাদারি কাজ পায় এই প্রতিষ্ঠান। আতাউর রহমান সম্প্রতি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ পান। এই আসনের বর্তমান সাংসদ বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির মালিক মোরশেদ আলম এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বর্তমান সাংসদ এম এ আউয়ালের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে ঋণ খেলাপের দায়ে। আউয়াল ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক তরীকত ফেডারেশনের মনোনয়নে সাংসদ হয়েছিলেন। সম্প্রতি তাঁকে তরীকত ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই আসনে এবার তরীকত মনোনয়ন দিয়েছে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের মালিক আনোয়ার হোসেন খানকে। অবশ্য আনোয়ার খান রামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর আউয়াল এবার জাকের পার্টির হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
ঢাকা-১৭ আসনে আকবর হোসেন পাঠান ওরফে চিত্রনায়ক ফারুকের মনোনয়ন প্রথমে স্থগিত রাখা হয়েছিল। তিনি নিজে এবং সমর্থনকারী ও প্রস্তাবকারী উপস্থিত না থাকায় স্থগিত রাখা হয়েছিল। পরে নায়ক ফারুক নিজে এলে তাঁর প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়। অবশ্য এই আসনে সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদারও মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তাঁর দল তৃণমূল বিএনপি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের হয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট করবেন বলে নির্বাচন কমিশনে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে নাজমুল হুদার মনোনয়নপত্রে তিনি কোনো দলের নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী, সেটা উল্লেখ না করার কারণে বাদ পড়েন।
ঢাকা-১৭ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁকেই শেষ পর্যন্ত মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেওয়া হবে বলে আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে।
আরও যাঁরা বাদ পড়েছেন
চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নূর হাকিম বাদ পড়েছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ আলী আজগার। পিরোজপুর-৩ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলামের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তবে বর্তমান স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁকেই মহাজোটের প্রার্থী করা হতে পারে বলে আলোচনা আছে।
নওগা-২ আসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক আখতারুল ইসলাম বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। ভোটারদের তালিকায় গড়বড়ের অভিযোগে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। এই আসনের বর্তমান সাংসদ শহীদুজ্জামান সরকারদলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। নওগাঁ-৬ আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী রানীনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেনের মনোনয়নপত্রও একই কারণে বাদ পড়েছে। এখানে দলীয় মনোনয়ন পান বর্তমান সাংসদ ইসরাফিল আলম।